হযরত কাসিম (আঃ)-এর জীবন ও শাহাদাত।
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
৪৬ হিজরী ৭ই শাবানে মাওলা কাসিম(আঃ) শুভাগমন করার পর ইমাম হাসান(আঃ) এই পুত্রের নাম রাখেন 'কাসিম', যার অর্থ বণ্টনকারী । ইমাম হাসান(আঃ) জান্নাতের যুবকদের সর্দার এবং তার পিতা মাওলা আলী(আঃ) জান্নাত ও জাহান্নামের বণ্টনকারী, বন্টণের ওয়ারিস হচ্ছেন শাহজাদা কাসিম(আঃ), দোজাহানের যা কিছুই বন্টণ হয় তা সবই কাসিম(আঃ)-এর পবিত্র নুরের মাধ্যমে হয়ে আসছে এবং হবে৷ শাহজাদা কাসিম(আঃ) তার দাদা মাওলা আলী(আঃ)-এর বণ্টনকারী উপাধির জ্বল জ্যান্ত ব্যাখা ও ওয়ারিস যিনি ইমাম হাসান(আঃ)-এর পুত্র হিসেবে দুনিয়ায় শুভাগমন করেছেন ।
৫০ হিজরী তে শামের জালিম শাসক ধূর্ত মুয়াবিয়া(লাঃ) ইমাম হাসান (আঃ) কে বিষ পান করিয়ে দেয় এবং ২৮ সফর ইমাম(আঃ) শাহাদাত বরণ করেন, শাহাদাতের আগে পাপিষ্ঠ কুলাঙ্গার মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান (লাঃ) হযরত ইমাম হাসান (আঃ) এর প্রথম স্ত্রী জো'আদা বিনতে আশশাস (লাঃ) কে প্রস্তাব দেয়, প্রস্তাবটি ছিলো - "হে বিনতে আশশাস! তোমাকে শামের সকল মহিলাদের সর্দার ও আমার উত্তরাধিকারী ঘোষিত করবো, আমার পুত্র ইয়াযিদ এর সাথে বিবাহ করাবো, এই সকল কিছুর বিনিময়ে তুমি আলীর পুত্র হাসান আবা মুহাম্মাদ কে হত্যা করে ফেলো, হত্যা করার যেকোনো উপায়ে আমি সাহায্য করবো । "
জো'আদা(লাঃ) এই প্রস্তাব টি পাওয়ার সাথে সাথেই রাজি হয়না, একই প্রস্তাব মোট ৯ বার করা হয়, প্রত্যেকবার প্রস্তাব মানতে রাজি না হওয়ার কারন ছিলো জো'আদা বেশিরভাগ সময়ই মাওলা ইমাম হাসান (আঃ) কে দেখতে পেতো, মাওলা হাসান (আঃ) যখন খাবার খেতে বসতেন, তখন প্রায়শই জো'আদা কে ডেকে স্ত্রী দের সাথে খেতে বসাতেন । ইমাম হাসান (আঃ) যখন রাতের ইবাদতের জন্য ইবাদতগাহ তে যেতেন তার পুর্বে তিনি জো'আদা কে ডেকে জিজ্ঞেস করতেন, "হে জো'আদা! আমি ফাতিমা ও আলীর পুত্র! আমার মাঝে এমন কোন মন্দ ব্যাপার আছে যেটি তোমার কাছে ভালো লাগেনা?"
"আমি এমন কোন কাজ সম্পাদন করেছি যার ফলে তোমার মনে আমার জন্য মন্দ ধারনা আসে?"
জো'আদা এসব শুনে শুধু বলতো, "হে আমীর! এমন কিছু নেই, আমার মনে কোনো মন্দধারনা নেই।"
কিন্তু ইমাম হাসান (আঃ) জানতেন জো'আদা মিথ্যা বলে যাচ্ছে । জো'আদা ছিলো এক মুনাফিক আশশাস বিন কায়েস এর কন্যা, এই ব্যক্তিও মাওলা আলী(আঃ) এর হত্যাকারী ইবনে মুলজিম (লাঃ) কে নিজের ঘরে ঠাই দিয়ে মেহমান করেছিলো এবং মসজিদে তার বাসা থেকে ইবনে মুলজিম (লাঃ) রওনা হয়ে মাওলাকে হত্যা করেছিল, সেই মুনাফিকের কন্যা জো'আদার মনেও ইমাম হাসান (আঃ) এর জন্য স্নেহ ও ভালবাসা সৃষ্টি হয়নি কখনও, আল্লাহর সৌন্দর্যের প্রতিচ্ছবি ইমাম হাসান (আঃ) এর উত্তম চরিত্র, আচরণ, মহানুভবতা ও সততা কে জো'আদা লক্ষ্য করতে অক্ষম ছিলো কারন সে নিজের মন কে শয়তানের ঘর বানিয়ে ফেলেছিলো তাই তালাবদ্ধ হৃদয়ে হাসানের ভালবাসা কে অনুভব করা সম্ভব হয়নি।
ইমাম হাসান (আঃ) কে হত্যার জন্য জো'আদা যখন রাজি হতে চাচ্ছে না তখন মুয়াবিয়া(লাঃ) বিভিন্ন মাধ্যমে ইমাম (আঃ) কে বিষ প্রদান করার চেষ্টা করে কিন্তু সেই বিষপ্রদান দ্বারা সে সফল হয়না, মোট ১১ বার চেষ্টা করা হয় এর মধ্যে ৬ বার ইমামের মুখে বিষ পৌছে কিন্তু তিনি তা বের করে ফেলে দেন এবং বলেন, "আমার বিদায়ের তারিখ আমি জানি, যেদিন বিদায়ের দিন সেদিন হাসান অবশ্যই চলে যাবে, তবে তার আগে বিষ দিয়ে আমার মন ও দেহ কে বার বার দূর্বল করে দিচ্ছে তারা । "
ইমাম হাসান (আঃ) সফরের মাসের চাঁদ দেখে বললেন, "এই মাসে আমি আমার বাবা,মা ও নানাজানের সাথে মিলিতো হয়ে যাবো তবে দুঃখ হয় যে আমার ভাই হুসাইন ও বোন যাইনাবকে নিজের বুকে নিয়ে জড়ানোর দিনগুলো আর বাকি মাত্র কয়েকদিন। "
শাহাদাতের আগের রাতে ইমাম হাসান (আঃ) স্বপ্নে দেখেন রাসুলুল্লাহ (সাঃ), মা সৈয়দা ফাতিমা (সাঃআঃ) ও বাবা মাওলা আলী (আঃ) এসেছেন এবং বলেছেন, "হে আমার নির্যাতিত সবুজ হয়ে যাওয়া সন্তান, এবার তোমার বিদায়ের সময় এসে গেছে! ও হাসান! আর দেরি করোনা। "
ইমাম (আঃ)এই স্বপ্ন দেখার পর বলেছিলেন, "ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন! "
২৮ সফর এশা ও তাহাজ্জুদ সময়ের মাঝামাঝি সময়ে ইমাম হাসান (আঃ) তার ঘরে অবস্থান করছিলেন এমন সময় জো'আদা (লাঃ) এসে ইমাম (আঃ) এর সামনে দুধের পাত্র রেখে দেয়, জো'আদা চলে যাবার আগে ইমাম(আঃ) বলেন, "হে জো'আদা! কেমন আছো?"
জো'আদা বলল, "আল্লাহর শোকর "
ইমাম (আঃ) বললেন, "আজ তুমি নিজেই আমার হাতে এই পাত্রটি দিয়ে দাও! "
জো'আদা ভয় পাচ্ছিলো তখন, ইমাম (আঃ)কে পাত্রটি দিলো, ইমাম হাসান(আঃ) বললেন, "একটি প্রশ্ন করতে পারবো কি?"
জো'আদা বলল, "জী, আমীর"
ইমাম বললেন, "আমার মধ্যে একটি গুনও কি তোমার দ্বারা পরিলক্ষিত হয়নি?"
জো'আদা বলল, "আমীর, আমাকে অনুমতি দিন, আমি এখন যেতে চাই। "
ইমাম (আঃ) বললেন, "ঠিক আছে, আল্লাহ হাফেয, ভালো থেকো যদি মনে করো তারা তোমাকে ভাল রাখতে পারবে তবে দ্বীনের ব্যাপারে আমার আল্লাহই আমাকে নিযুক্ত করেছেন ।"
জো'আদা সেই কামরা হতে বের হয়ে যায়, এরপর ইমাম হাসান (আঃ) সেই দুধ পান করেন, কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকেন তারপর নিজের বুকের কলিজায় হাত দেন, একটিবার চিৎকার দেন,
"ও আমার মা! ও ফাতিমা যাহরা! আমার কলিজা ফেটে যাচ্ছে মা!" - এই কথা বলে কান্না করেন,
ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রহরীরা এই চিৎকার শুনে ভিতরে এসে দেখেন ইমাম হাসান (আঃ) বিছানায় শুয়ে বুকে হাত দিয়ে কান্না করছেন, তারা তৎক্ষণাৎ ইমাম হুসাইন (আঃ) কে খবর দেন, ইমাম হুসাইন (আঃ) এই খবর পেয়ে দৌড়ে ছুটে আসেন, এসে দেখেন ভাইয়ের উপর অত্যন্ত জঘন্য পৈশাচিক নির্যাতন করা হয়েগেছে! ইমাম হুসাইন(আঃ) ভাই হাসান কে জড়িয়ে বলেন, "ও আমার ভাই! কে তোমাকে এই অবস্থায় ফেললো?"
ইমাম হাসান (আঃ) বললেন, "ভাই তার চেয়ে বেশি অপরাধী যে তাকে দিয়ে এটা করিয়েছে, মুয়াবিয়া শুধু আমার নয় বরং আল্লাহ ও রাসুলের শত্রু, সে ওয়াদা ভঙ্গ করেছে, আমার লিখা সন্ধির বিপরীত কাজ করেছে ! এখন বেশি সময় নেই, ফারওয়া কে ডাকো আমার কাসিম কে ডাকো! "
প্রিয়তমা স্ত্রী ফারওয়া(আঃ) ও প্রিয়পুত্র কাসিম (আঃ) কে ইমাম হুসাইন (আঃ) যখন খবর দিলেন, তাদের উপর যেন আকাশ ভেঙে পড়লো, শাহজাদা কাসিম(আঃ) এর বয়স তখন সাড়ে তিন বছর, বাবা হাসান (আঃ) কে দেখে শাহজাদা কাসিম (আঃ) বলেন, "ও বাবাজান! কি হলো তোমার বাবা! তোমার চোখে জ্বল কেন? বাবা, তোমার চোখ এমন ঝলসে গেছে কেন? বাবা বলো কি হয়েছে? "
ইমাম হাসান (আঃ) বললেন, "কাসিম আমার কাছে এসো! "
ইমাম হাসানের বুকের কাছে কাসিম গেলেন, দেখলেন বাবা হাসানের বুক গরম হয়ে আছে আর মুখ থেকে বের হচ্ছে, কাসিম কাদতে কাদতে বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন, "বাবা, তোমার বুক গরম কেন? তোমার মুখে রক্ত কেন?"
ইমাম হাসান (আঃ) কাসিমের হাত ধরে চুমু দিলেন ও মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, "বেশি সময় নেই বাবা, তোমাকে ফুপ্পি যাইনাবের ঘরে যেতে হবে, আমি শুধু আজ রাতের মেহমান, আমি চলে যাচ্ছি। "
কিন্তু এত ছোট শিশু কাসিম কিভাবে নিজের এতিমির খবর ফুপ্পি কে দিবেন তাই ইমাম হাসান(আঃ) কাসিম (আঃ)এর জামা ছিড়লেন এবং চুল গুলো এলোমেলো করে মাথার উপর বালু দিয়ে দিলেন, বললেন "এই অবস্থায় তোমার ফুপ্পি তোমাকে দেখলেই সব বুঝে যাবেন!"
কাসিম(আঃ) বললেন, "বাবা! সেটা কেমন অবস্থা যেটা তিনি বুঝে যাবেন? "
ইমাম (আঃ) কাদতে কাদতে বললেন, "সেটা তোমার এতিমির অবস্থা,বাবা।"
কাসিম(আঃ) বুঝে গেলেন তিনি এতিম হয়ে যাবেন, কাদতে কাদতে চলে যাচ্ছেন তখন ইমাম হাসান (আঃ) বললেন, "ও কাসিম! আমার বোন যাইনাব এখন ঘুমাচ্ছেন, আমার বোন কে ঘুম থেকে জাগিও না, তুমি তার দরজা তে বসে অপেক্ষা করবে, যখন তাহাজ্জুদের ওয়াক্ত হবে তখন সে জাগবে, তখন তুমি দরজাতে ডাক দিও । "
কাসিম (আঃ) দৌড়িয়ে বের হলেন, রাতের অন্ধকারে কাদতে কাদতে ফুপ্পির দরজায় গেলেন, দরজাটি বন্ধ তখন বাবাজানের কথাটি মনে করে দরজার কড়া নড়লেন না, দরজার চৌকাঠে বসে পড়লেন এবং ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না করতে করতে বললেন, "ও আমার ফুপ্পি! তারাতারি জাগ্রত হও! এক রাতের মেহমান তোমার ভাই! আমার বাবাকে বিষ দিয়েছে! ফুপ্পি আম্মা! আজ দেরি করোনা! তোমার কাসিম এতিম হয়ে গেছে মা । "
কান্নার আওয়াজ শুনে হযরত যাইনাব (সাঃআঃ) এর ঘরে উপস্থিত কানিয বিবি ফিজ্জা(আঃ) বের হয়ে দরজা খুললেন, প্রথমে তিনি চিনতে পারেননা শাহজাদা কে, অতঃপর কাসিম (আঃ) বলেন, "ফুপু জেগে থাকলে, আমার ফুপু কে বলুন, আমি কাসিম, আজ এতিম হয়ে গেছি, তার ভাই হাসান ছটফট করছেন। "
যাইনাব (সাঃআঃ) বেরিয়ে আসেন, কাসিম (আঃ) এর অবস্থা দেখেই সব বুঝে যান, সাথে বোন উম্মে কুলসুম (সাঃআঃ) এবং ভাতিজা কাসিম (আঃ) কে কোলে নিয়ে রওয়ানা হন ইমাম হাসানের বাসায়।
ইমাম হাসান (আঃ) তার মুখ দিয়ে রক্তের বমি করতে করতে এক পর্যায়ে তিনি নিজের মুখে তার বুকের ভিতর কলিজার টুকরাগুলো বের করা শুরু করলেন, ইমাম হুসাইন (আঃ) একটি পাত্রে বমির সাথে বের হওয়া কলিজার টুকরা গুলো রাখছেন, ইমাম হাসান (আঃ) বলছিলেন, "ভাই হুসাইন, তুমি এটা লুকিয়ে ফেলো! যাইনাব এটা সহ্য করতে পারবে না। "
তখনি হযরত যাইনাব (সাঃআঃ) উপস্থিত হন এবং বলেন, "ভাইজান, আমার থেকে লুকিয়ে ফেলার দরকার নেই, আমি বোন হয়ে না, আজ তোমার মা ফাতিমা হয়ে এসেছি! ভাই দেখাও তোমার দেহ কেমন রঙে রাঙানো হল!"
কাছে গেলেন দেখলেন এবং বললেন,
"হায় রাসুলুল্লাহ! নানাজান তোমার উম্মতের অত্যাচার আমার ভাইয়ের উপর! আমার ভাইয়ের সমস্ত দেহ সবুজ হয়ে গেছে! আমার ভাইয়ের চোখদুটো কতইনা সুন্দর ছিলো, তার চোখদুটো নানাজানের মতো ছিলো আর এখন ঝলসে গেছে!!"
ইমাম হাসান (আঃ) ভাই হুসাইন(আঃ)কে বললেন, "আমার কাসিম কে আমার কাছে দাও ভাই।"
অতঃপর কাসিমের হাতের উপর ইমাম হুসাইনের হাত রেখে বললেন, " ভাই হুসাইন, আমার এই সন্তান কে এতিম মনে করে দূর্বল ভেবোনা, সেও তোমার সাহায্যকারী হবে কারবালার ময়দানে এমন ভাবে নিজেকে কুরবান করবে যা আর কেউ সেভাবে পারবে না।"
ইমাম হুসাইন (আঃ) কাসিম কে বুকে জড়িয়ে বললেন, "কাসিম তুমি আমারও সন্তান। "
এই সময় শাহজাদা কাসিম(আঃ)-এর বয়স ছিল মাত্র ৩ বছর ।
১১ বছর পর্যন্ত শাহজাদা কাসিম(আঃ) কে তার আপন চাচা মাওলা ইমাম হুসাইন(আঃ) স্নেহ ও ভালবাসার সাথে লালন পালন করেছেন, অত্যন্ত যত্ন ও আদর পেয়েছেন চাচা ইমাম হুসাইন (আঃ) থেকে । ইমাম হাসান(আঃ)-এর এতিম পুত্র কে কখনোই এতিম অনুভব হতে দেননি ইমাম হুসাইন(আঃ) ।
শাহজাদা কাসিম (আঃ) ছিলেন পিতা ইমাম হাসান(আঃ)-এর সৌন্দর্য্য ও মাধুর্যের জ্বল জ্যান্ত ওয়ারিস, তিনি পিতার সাদৃশ্য ছিলেন এবং ইমাম হুসাইন(আঃ) শাহজাদা কাসিম(আঃ)কে দেখলেই ভাই হাসানের ছেড়ে যাওয়ার দুঃখ ভুলে যেতেন, বলতেন - "আমার ভাই তার বাল্যকালে যেমন ছিল তা দেখতে হলে কাসিম কে দেখে নাও, সে তার পিতার প্রতিচ্ছবি । "
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ইমাম হাসান(আঃ) ও ইমাম হুসাইন(আঃ) কে দুইধরনের লকব (উপাধি) দিয়েছিলেন, হাসান(আঃ) কে আমীরে আমান(শান্তির বাদশাহ) উপাধি এবং হুসাইন(আঃ) কে মাযলুমে গারিব(নির্যাতিত ও লোটানো ব্যক্তি; যার সব কিছু লুটে যাবে) তাই ইমাম হাসান(আঃ)-এর এই পুত্র কাসিম(আঃ)কে ইমাম হুসাইন(আঃ) একজন বাদশাহের পুত্র হিসেবেই যত্ন করতেন৷ স্বভাবতই শাহজাদা কাসিম(আঃ)-এর কথাবার্তা বলা ও আচরণ ছিলো অত্যন্ত মধুর ও বাবা হাসানের মতই । একজন বাদশাহের পুত্র যেমন হয়, ঠিক তেমনি, তার দেহের ব্যাপারে ইমাম হাসান(আঃ) তার ভাই হুসাইন(আঃ)কে বলে যান, "আমার চোখের জ্যোতি কাসিম কে বেশি শক্ত জামা দিবে না, তার দেহের চামড়া ও মাংস অত্যন্ত নরম, বেশি শক্র শুতোর জামা পরলে তার চামড়া লাল হয়ে যায়, রক্তাক্ত হয়।"
শাহজাদা কাসিম(আঃ)-এর পবিত্র মাতা সৈয়দা উম্ম ফারওয়া(সাঃআঃ)তার এই একমাত্র পুত্র কে খুব বেশি ভালবাসতেন, সর্বদাই পুত্র কাসিম(আঃ)কে নিজের সাথে রাখতেন, স্বামী মাওলা হাসানের একমাত্র চিহ্ন তার জন্য ছিলো কাসিম(আঃ) ।
সৈয়দা যাইনাব কুবরা (সাঃআঃ)ও সৈয়দা যাইনাব সুগরা (সাঃআঃ) যখনই ইমাম হাসানের শাহজাদা কাসিম(আঃ)কে দেখতেন, তারা ইমাম হাসানের নামেই সালাম দিতেন, তারা ভাতিজা কাসিম(আঃ)-এর মধ্যেই ভাই হাসান(আঃ) কে দেখতে পাইতেন ।
৯ বছর বয়স থেকে শাহজাদা কাসিম(আঃ) চাচা মাওলা আবুল ফযল আব্বাস(আঃ) এবং চাচাতো ভাই মাওলা আলী আকবর(আঃ) নিকট যুদ্ধের কলাকৌশল শিক্ষা নিয়েছেন, খুব কম বয়সী হলেও তিনি এমনভাবে বিষয়টিকে গুরুতর মনে করতেন তা দেখে আহলেবাইত(আঃ) মারহাবা বলতেন। শৌর্য বীর্যবান যুবকের মতই তিনি কলাকৌশল শিক্ষা নিয়ে দাদা মাওলা আলী(আঃ)'র মত বীরত্ব অর্জন করেন ।
মাওলা আব্বাস(আঃ) বলেছেন, "আমি সিফফিনের ময়দানে ১৪ বছর বয়সে যেভাবে শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি, ঠিক তেমনি যুদ্ধ কাসিম করবেন কারবালার ময়দানে, তার বয়সও ১৪ থাকবে, আমাকে যেভাবে বাবা মাওলা আলী(আঃ) মারহাবা বলেছেন, আমিও কাসিম(আঃ)কে মারহাবা বলব। "
শাহ্জাদা কাসিম (আঃ)-এর নির্মম শাহাদাত যেভাবে হয়েছিলো ।
৬১ হিজরীর ৯ই মুহাররামের রাতে, ইমাম হুসাইন (আঃ) কাগজে লিখে নামের তালিকা তৈরী করে রেখেছিলেন যারা যারা আগামীকাল অর্থাৎ আশুরার দিন ময়দানে যাবে, ইমাম(আঃ) প্রত্যেকের নামগুলো সাহাবিদেরকে জানাচ্ছিলেন, শাহজাদা কাসিম(আঃ) অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলেন কিন্তু নিজের নাম চাচাজান মাওলা হুসাইন(আঃ)-এর মুখে শুনতে পেলেন না । চাচাজানের কাছে যেয়ে শাহজাদা কাসিম(আঃ) বললেন, "হে আমার মাওলা! আপনি তো আমার নামটি উচ্চারণ করলেন না!"
মাওলা হুসাইন(আঃ) বললেন, "হে কাসিম! তুমি আমার ভাইয়ের প্রতিচ্ছবি, তার আমানত, আমি আমার অনুসারীদের নাম জানিয়েছি যারা আমাকে সাহায্য করবে । "
শাহজাদা (আঃ) তার মায়ের তাবুর দিকে চলে গেলেন, মা উম্মে ফারওয়া(আঃ) বললেন, "হে আমার পুত্র! তোমার চাচাজানের প্রতি নিজেকে আগামীকাল উৎসর্গ করে দিও, তোমার বাবা হাসান(আঃ) এখন নেই, তুমিই উনার পক্ষ হয়ে মাওলা হুসাইন(আঃ) কে সাহায্য করবে, সবাই যেন তোমার উৎসর্গিত হওয়াকে সর্বদা স্মরণ করে, বাবা হাসানের প্রতি লোকেরা অপবাদ দিয়েছে তিনি লড়াই করতে পারতেন না; তাই আগামীকাল তুমি এটা ময়দানে প্রমাণ করে দিও হাসানপুত্রের বীরত্ব কেমন!"
শাহজাদা কাসিম(আঃ)-এর চোখে পানি, মা জিজ্ঞেস করলেন, "কি হলো! তুমি কাদছো কেন?"
কাসিম(আঃ) বললেন, "মা, চাচাজান তো বোধহয় আমার নাম কালকের শহিদদের তালিকায় রাখেন নি। "
মা উম্মে ফারওয়া(আঃ) বললেন, "হে কাসিম! আমি তোমাকে নিয়ে সারাজীবন বিয়ের স্বপ্ন দেখেছি, আমার পুত্রকে বিবাহ করাবো, তোমার ভরা ঘরকে দেখার স্বপ্ন দেখতাম কিন্তু যখন থেকে তোমাকে নিয়ে মদিনা ত্যাগ করলাম, আমি সব স্বপ্নগুলো বিসর্জন দিয়েছি এখন তোমার মায়ের শুধু একটাই ইচ্ছে, তা হলো তোমাকে মাওলা হুসাইনের জন্য উৎসর্গ করা, তোমার চাচাজান হুসাইন খুব বেশি নির্যাতিত, তাকে তার অনুসারীরা সাহায্য করতে আসেনি, তিনি নবীকন্যা ফাতিমা যাহরা(আঃ)-এর দুলাল পুত্র, তাকে উম্মতেরা সঠিক মর্যাদা দিতে পারেনি বরং তার উপর অত্যাচার করছে, গ্রেফতার করেছে, পানি বন্ধ করেছে । হে কাসিম(আঃ)! তোমাকে আগামীকাল আমি তোমার বাবা হাসান(আঃ)-এর পক্ষ থেকে উৎসর্গ করতে চাই, এসো তোমাকে আমি তোমার চাচাজানের কাছে নিয়ে যাই । "
শাহজাদা(আঃ) কে নিয়ে উম্মে ফারওয়া(আঃ) তাবু থেকে বের হলেন, মাওলা হুসাইন(আঃ)-এর কাছে নিয়ে গেলেন, মাওলা (আঃ) উম্মে ফারওয়া(আঃ) কে দেখে বললেন, "হে আমার ভাইয়ের আমানত! আপনি কেন কষ্ট করে আমার নিকট আসলেন! আমাকে আহবান করতেন, আমি নিজেই আপনার তাবুর দরজায় এসে যেতাম। "
উম্মে ফারওয়া(আঃ) নিজের দুইহাত জোড়ে বললেন, "মাওলা, আপনার কাছে আমি কখনোই কিছু আবদার করিনি, আমি আজ অনুরোধ করছি, আমার পুত্র কাসিমকে আপনার সেনাতে শামিল করে নিন । "
মাওলা হুসাইন(আঃ) বললেন, "ঠিক আছে, কাসিম কে আমার কাছে দিয়ে আপনি তাবুর ভিতর চলে যান । "
শাহজাদা স্বস্তি বোধ করতে লাগলেন, চাচাজানের কাছে আসলেন, মাওলা তাকে বললেন, "হে আমার পুত্র কাসিম! তুমি চিন্তিত হয়োনা, কারণ কালকে যারা আমাকে সাহায্য করবে তাদের মধ্যে শুধু তোমার নামই নয় বরং তোমার ছোট ভাই আলী আসগরের নামও আছে। "
শাহজাদা (আঃ) অবাক হয়ে গেলেন, তিনি বললেন- "হে মাওলা! আমাকে সবার আগে সুযোগ দিবেন আমার পরিবারের কারও শাহাদাত হওয়ার আগে । "
আশুরার সুর্যদয় হলো, একের পরে এক হুসাইনি প্রেমিক নিজেকে মাওলার চরণে উৎসর্গ করছে, এক পর্যায় সকল অনুসারী শহীদ হয়ে গেলেন । এবার পালা এলো, বনি হাশিমিদের, মাওলার চরণে উৎসর্গ করলেন মাওলা আলীর(আঃ) বেশ কয়েকজন পুত্র, মাওলা আব্বাস(আঃ) ও শাহজাদা আলী আকবর(আঃ) আলোচনা করছেন এখন কে ময়দানে যাবে! মাওলা আব্বাস(আঃ) বলছেন, "আমি ময়দানে যাব, হে আলী আকবর আমার মাওলা হুসাইনের চোখের জ্যোতি, তুমি শহিদ হলে উনার চোখের জ্যোতি চলে যাবে, তাই আমি যাব। " শাহজাদা আলী আকবর(আঃ) বলছেন, "না, চাচা আপনি আমার বাবার কোমরের শক্তি, আপনি চলে গেলে উনার কোমরের শক্তি চলে যাবে, তাই আমি যাব । " এই কথোপকথন শাহজাদা কাসিম শুনলেন, বললেন- "হে চাচা আব্বাস! আপনি ময়দানে মাওলা হুসাইনের কোমরের শক্তি চলে যাবে এবং ভাইয়া আলী আকবর ময়দানে গেলে মাওলা হুসাইনের চোখের জ্যোতি চলে যাবে, তাই আমি হাসানের এতিম পুত্র! আমি ময়দানে গেলে কারও কোমরের শক্তিও যাবেনা আর কারও চোখের জ্যোতিও কমবে না। "
কাসিম(আঃ)-এর এই কথা ইমাম হুসাইন(আঃ) শুনে ফেলেন, দৌড়ে এসে ভাতিজা কাসিম(আঃ)-কে বুকে জড়িয়ে বলেন, "হে কাসিম! তোমাকে আমি আলী আকবরের চেয়ে বেশি ভালবাসি। "
মা উম্মে ফারওয়া(আঃ) কাসিম(আঃ) কে ডেকে বললেন, "হে কাসিম! বনি হাশিমি পুরুষেরা শহিদ হচ্ছেন তুমি কেন এখন পর্যন্ত জীবিত আছো? যাও, নিজেকে মাওলা হুসাইনের প্রতি উৎসর্গ করো, আমাকে লজ্জিত করোনা । "
শাহজাদা কাসিম(আঃ) মাওলা হুসাইন(আঃ)-এর কাছে গেলেন, বললেন- "হে মাওলা! আমি ময়দানে যেতে চাই আমাকে অনুমতি দিন । " মাওলা হুসাইন(আঃ) কাসিম(আঃ)কে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নিলেন, বললেন- "হে কাসিম! তুমি আমার ভাইয়ের প্রতিচ্ছবি, তার চিহ্ন! তোমাকে কি করে আমি ময়দানে পাঠাই! আমার যে মন খুব বিচলিত হচ্ছে!"
চাচাজান হুসাইন(আঃ)কে কয়েকবার কাসিম(আঃ) অনুরোধ করলেন কিন্তু চাচাজান রাযিই হচ্ছেন না, মা উম্মে ফারওয়া(আঃ)-এর কাছে গেলেন, মা বললেন- "হে কাসিম! আমি যেন তোমাকে দ্বিতীয়বার আর না দেখি! কেন তুমি বিলম্ব করছো?" কাসিম(আঃ) খুব পেরেশান হয়ে গেলেন, কি করবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না, এদিকে চাচাজান অনুমতি দিচ্ছেন না, অন্যদিকে মা চেহারা দেখতে চাইছেন না ! এমতাবস্থায়, কাসিম(আঃ)-এর বাবা মাওলা হাসান(আঃ)-এর কথা মনে পড়ে গেলো, তিনি বলেছিলেন, "হে কাসিম! আমি তোমার হাতের বাযু তে একটি তাবিয বেধে দিচ্ছি, যখন খুব বেশি বিপদে পড়বে এবং কোনো উপায় খুজে পাবেনা, তখন এই তাবিযটি খুলে পড়ে নিবে, তোমার সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে।"
কাসিম(আঃ) নিজের হাত থেকে তাবিযটি খুলে ফেললেন, দেখলেন কাগজে লিখা আছে, "হুসাইন কে তার ভাই হাসান", কাসিম(আঃ) এটা নিয়ে দৌড়ে চাচাজান হুসাইন(আঃ)-এর কাছে চলে গেলেন, বললেন- " মাওলা আপনার জন্য পত্র এনেছি!" মাওলা বললেন, "এই দুঃসময়ে আমার মত অসহায়কে কে পত্র পাঠালো?"
কাসিম(আঃ) বললেন, "এটা আপনার ভাই হাসান আমাকে দিয়েছিলেন, আপনার জন্য । "
মাওলা(আঃ) পত্রটি হাতে নিয়ে পড়লেন, তাতে লিখা ছিলো-
" -- হে আমার ভাই হুসাইন! জানি এই পত্র যখন তুমি পড়বে তখন তুমি খুব বড় বিপদে, আমার উপর বিষপ্রয়োগের ফলে আমি তোমার সাথে কারবালায় থাকব না কিন্তু আমি অনুরোধ করছি, ভাই হিসেবে ভাইয়ের পক্ষ হতে তুমি আমার কাসিম কে তোমার প্রতি উৎসর্গিত হওয়ার জন্য অনুমতি দিও, সে অন্যন্য ভাবে তোমার প্রতি নিজেকে উৎসর্গ করবে ।
তোমার ভাই, হাসান । -- "
মাওলা হুসাইন(আঃ) পত্র পড়ে উঠে দাড়ালেন আর বললেন, "আল্লাহু আকবর! আমার ভাই কাসিমের মাধ্যমে আমাকে অসিয়ত করেছেন এবং আমাকে অসিয়ত করেছিলেন, আমি যেন আমার কন্যা ফাতিমা কুবরাকে কাসিমের সাথে বিবাহ দেই ৷ "
শাহজাদা বললেন, "হে মাওলা! আমাকে ক্ষমা করুন, আমি আপনার কন্যাকে বিধবা করতে চাইনা, আমাকে শুধু ময়দানে যেতে দিন। "
মাওলা হুসাইন(আঃ) বললেন, "আমি আমার ভাইয়ের অসিয়ত কে অবশ্যই পালন করব, এতে আমার কন্যা বিধবা হবে তবে তাতে আমার ভাইয়ের শেষ ইচ্ছে তো পালন হবে। "
অতঃপর মাওলা হুসাইন(আঃ) নিজ কন্যা ফাতিমা কুবরা(আঃ)-এর সাথে শাহজাদা কাসিম(আঃ)-এর বিবাহ পড়িয়ে দিলেন । শাহজাদা কাসিম(আঃ)কে ফাতিমা কুবরা(আঃ) বললেন, "হে কাসিম! ময়দানে যাওয়ার আগে এটাতো বলে যাও, আমি কিয়ামতের দিন তোমাকে চিনবো কিভাবে?"
কাসিম নিজের জামার কিছু অংশ ছিড়ে বললেন, "যখন দেখবে একজন বরের কাপড় ছিড়া ও দেহে প্রচুর ক্ষতাঘাত, তখন বুঝে নিও সেই তোমার কাসিম!"
ইমাম হুসাইন (আঃ) শাহজাদা কাসিম(আঃ) কে জিজ্ঞেস করেন, "হে কাসিম! বলো মৃত্যু তোমার কাছে কেমন?"
শাহজাদা কাসিম(আঃ) বলেন, "আপনার জন্য মরে যাওয়া, আমার নিকট মধুর চেয়েও বেশি মিষ্টি । "
শাহজাদা(আঃ) কে যুদ্ধের বস্ত্র পরানোর জন্য ইমাম হুসাইন(আঃ) মাওলা আব্বাস(আঃ) কে বললেন, মাওলা আব্বাস(আঃ) কাসিম(আঃ) কে যুদ্ধবস্ত্র পরাতে চেষ্টা করছেন কিন্তু যুদ্ধের বস্ত্রগুলো কাসিম(আঃ)-এর দেহে সঠিকভাবে পরিধান করানো যাচ্ছেনা কারণ উনার বয়স মাত্র ১৩ বছর আর বস্ত্রগুলো বানানো হয়েছে যুবকদের জন্য ।
মাওলা হুসাইন(আঃ) কে মাওলা আব্বাস(আঃ) জানালেন কাসিম(আঃ)-এর যুদ্ধবস্ত্র নেই এবং কাসিমের দেহে সেগুলো পরানো যাচ্ছেনা । কাসিম(আঃ) বললেন, "মাওলা! আমি যুদ্ধবস্ত্র চাইনা, আমি আমার এই কাপড়েই ময়দানে যাব, আমাকে অনুমতি দিন । "
মাওলা হুসাইন(আঃ) কাদতে কাদতে বলেন, "তোমার বাবা আমাকে বলে গিয়েছেন যে, তোমার দেহের মাংস খুব নরম ও তুলতুলে, তোমাকে যেন শক্ত জামা না পরাই, আর তুমি এখন পরনের কাপড়ে ময়দানে এই পশুদের মাঝে যেতে চাচ্ছো? বলো আমি তোমার বাবা হাসান কে কি উত্তর দিব?!"
শাহজাদা কাসিম(আঃ) বললেন, "আমি এই অবস্থাতেই ময়দানে যাব, লোকেরা বুঝবে আমি হাসানেরপুত্র, আমি আমার বাবার বীরত্বের প্রমাণ দিব । "
শাহজাদা কাসিম(আঃ) কে ঘোড়ায় চড়ানো হলো, তার পা দুটো ঘোড়ার পেটের নিচে নামলো না,তাও তিনি ঘোড়া নিয়ে অগ্রসর হলেন, শত্রুরা দেখলো, "হুসাইনের তাবুগুলো থেকে হঠাৎ ঘোড়ার উপর যেন চাঁদ দৌড়ে আসছিলো, এত সুউজ্জল মুখমন্ডল, মাথায় গুচ্ছ চুলগুলো হাওয়াতে উড়ছিলো৷ "
শাহজাদা কাসিম(আঃ) ময়দানে শত্রুদের কে বলতে লাগলেন, "হে আল্লাহ ও রাসুলের শত্রুরা, তোমরা নিজেদেরকে মুসলমান দাবী করো অথচ আল্লাহর হাবিবের বিরুদ্ধে তরবারি তুলেছো, তোমরা আমার দাদা আলী(আঃ) ও তার পুত্র হাসান(আঃ) কে হত্যা করেছো, এখন তোমরা মাওলা আবা আব্দিল্লাহ কে হত্যা করার জন্য জড়ো হয়েছো, আল্লাহর কসম! আমি হাসানের পুত্র সাক্ষ্য দিচ্ছি, তোমরা জঘন্য অপরাধ করেছো আমাদের উপর অস্ত্র তুলে, আজ আমি তোমাদেরকে আল্লাহর জন্য হত্যা করব। "
তিনি খুব সাহস ও শক্তির সাথে শত্রুদের উপর তলোয়ার দ্বারা আঘাত করতে থাকেন, তার উপর তীর ও তলোয়ার দ্বারা শত্রুরা আঘাত করতে থাকে, দেহ থেকে তাজা রক্ত কারবালার জমিনে পড়তে থাকে, তিনি শুধু মাওলা হুসাইন(আঃ)-এর দিকে তাকিয়ে বলতে থাকেন, "আপনার উপর কতইনা অত্যাচার করতে তারা পছন্দ করে! হায় আমার নির্যাতিত চাচাজান! আপনার উপর সালাম!"
মাওলা আব্বাস(আঃ) দেখেন, কাসিম(আঃ) অনেক শত্রুদেরকেই হত্যা করছেন, তিনি তাকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য, "মারহাবা- মারহাবা" বলতে লাগলেন । মাওলা হুসাইন(আঃ) নিজ কন্যা ফাতিমা কুবরা(আঃ)-এর তাবুর দিকে তাকিয়ে বলেন, "হে আমার কন্যা! বাবাকে ক্ষমা করে দিও, আমি তোমার সোহাগ কে রক্ষা করতে পারলাম, এই অত্যাচারী উম্মতের হাতে আমার কন্যার নব বরের জন্য কোনো দয়া হলোনা । "
শাহজাদা কাসিম(আঃ) তলোয়ার চালাতে চালাতে শীমার ও উমর বিন সাদ কে পেরেশান করে ফেললেন, তারা কোনোভাবেই শাহজাদাকে ঘোড়া থেকে ফেলতে পারছেন না, তারা চক্রান্ত করলো কোনোভাবে যেন এই বালককে মাটিতে ফেলা যায় তারপরেই তার উপর অনেক গুলো ঘোড়া ছেড়ে দেওয়া হবে, কারণ তারা দেখেছিলো শাহজাদা কাসিম(আঃ)-এর দেহে কোনো যুদ্ধবস্ত্র ছিলোনা, ইমাম হাসানের এই চাঁদের দেহের উপর ইয়াযিদি পিশাচদের বদনজর পড়লো, শাহজাদা কাসিম(আঃ) বলা হলো, আপনার তাবুগুলোর দিকে আমরা আগুনের তীর মেরেছি, সেখানে আগুন লেগে গেছে । শাহজাদা কাসিম(আঃ) শত্রুদের ভীর থেকে বের হওয়ার জন্য পিছনে যেতে লাগলেন, তখনই তারা লোহার একটি গোলক শাহজাদার পিঠের উপর নিক্ষেপ করলো, তিনি জোরে চিৎকার দিয়ে চাচাজানের প্রতি বললেন- "হে মাওলা হুসাইন আপনার কাসিমের শেষ সালাম গ্রহণ করুন। "
মাওলা হুসাইন(আঃ) তৎক্ষণাৎ ভাই আব্বাস(আঃ) কে তরবারি বের করে ডান দিকে যেতে বললেন আর নিজে বাম দিকে গেলেন, শত্রুদের উপর আক্রমন করে খুব দ্রুত দু'জন কাসিমের কাছে যাচ্ছেন এবং শীমার-উমর বিন সাদ খবর পেলো আব্বাস ও হুসাইন দুজন তরবারি সহ আসছে, তারা সাথে সাথেই ২০ টি ঘোড়া যেগুলোর ওজন ছিল ১০০ কেজিরও বেশি, সেগুলো একসাথে শাহজাদা কাসিম(আঃ) দিকে ছেড়ে দিলো, ঘোড়ার গুলোর ভারী পা আর মাওলা হাসানের পুত্র কাসিমের নরম দেহ যা ছিলো যুদ্ধবস্ত্র ছাড়া, জীবিত অবস্থায় শাহজাদা কাসিম(আঃ)-এর দেহের উপর ঘোড়া উঠে গেল, শুধু মাথা ব্যতীত কিছুই অবশিষ্ট রইলোনা, চেহারায়ও ঘোড়ার পায়ের দাগে প্রচুর চিহ্ন ।
মাওলা হুসাইন(আঃ) ও মাওলা আব্বাস(আঃ) দেখলেন, শত্রুরা চারপাশে চলে গেছে কিন্তু কাসিম(আঃ)-এর লাশ পাওয়া যাচ্ছেনা, মাওলা হুসাইন(আঃ) হাটু গেরে জমিনে বসে গেলেন, বলতে লাগলেন- "ও আমার কাসিম! কোথায় তুমি! তোমার চাচাজান তোমাকে নিতে এসেছেন! আমাকে সাড়া দাও!"
কোথাও কোনো উত্তর মাওলা পেলেন না, শত্রুদের কে জিজ্ঞেস করলেন, "হে জালিমেরা! বলো তোমরা আমার কাসিমের সাথে কি করেছো? "
তারাও কিছু বলছেনা, মাওলা হুসাইন(আঃ) দেখলেন, একটি কাপড় যা কাসিমের দেহে ছিলো, সেটি নিজের কাছে নিলেন, মাওলা হুসাইন(আঃ) বললেন, "হে কাসিম! তোমাকে তোমার যুগের ইমাম আহবান করছে, সাড়া দাও! "
শাহজাদা কাসিমের আধ্যাত্মিক ধ্বনি শুনতে পেলেন ঘোড়ার পায়ের গোড়ালি গুলো থেকে, মাওলা ঘোড়ার পায়ে হাত দিয়ে দেখেন একই কাপড়ের অংশ লেগে আছে, ঘোড়ার পা গুলো থেকে মাংস টেনে টেনে বের করলেন, নিজের আবা কে মাটিতে বিছিয়ে তার উপর সব গুলো মাংসের টুকরো রাখলেন ।
ভাই হাসান(আঃ) কে স্মরণ হলো, তিনি বলেছিলেন তার কাসিম এমন ভাবে শহিদ হবে যা আর কেউ হবেনা। তাই বাস্তবায়ন হল, কাসিমের মতো শাহাদাত কারও হয়নি ।
একটি কাপড়ের মধ্যে পেচিয়ে নিলেন কাসিমের লাশের টুকরো গুলো, কাধে নয় বরং বুকেই জড়িয়ে নিয়ে ফিরছেন আর শত্রুদের আনন্দের ঢোলবাজনা শুনে বলে যাচ্ছেন, "ও কাসিম! দেখো তোমার বিবাহের আনন্দ তোমারই হত্যাকারীরা করছে! আমার কন্যাকে বিধবা বানিয়ে উম্মতেরা নানা মুহাম্মাদের অবদানের প্রতিদান দিলো, হায় আমার ভাইয়ের প্রতিচ্ছবি, হায় আমার ভাইয়ের আমানত! "
তাবুর দিকে অগ্রসর হয়ে মা উম্মে ফারওয়া(আঃ) দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন কাসিম(আঃ)-এর শহিদ দেহ কে দেখবেন, মাওলা ছোট একটি কাপড়ের বস্তা আনলেন। মা উম্মে ফারওয়া(আঃ) বললেন, "হে আকা হুসাইন! আমি পুত্র এতিম হতে পারে কিন্তু এর অর্থ এটা নয় যে, তার লাশ টাও ময়দানেই ফেলে রাখা হবে! আমার কাসিম কোথায়?"
মাওলা হাটু গেরে বসে বললেন, "ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন! এই নিন আপনার কাসিম কে এই কাপড়ে পেচিয়ে এনেছি! "
মা কাপড়ের গিট খুললেন, দেখলেন চেহারার কিছু অংশ অবশিষ্ট কিন্তু প্রচুর ঘোড়ার পায়ের দাগ, আর মাংসের টুকরো গুলো থেকে কাসিমের পবিত্র দেহের সুঘ্রান আসছে । মা উম্মে ফারওয়া মাওলা হুসাইন(আঃ) কে বললেন, "আমার জীবনের মূল্যবান সম্পদ আমি আপনার চরণে উৎসর্গ করলাম, আমার কাসিমকে দেখার ও তার দেহ জড়িয়ে কান্না করার ইচ্ছা ছিলো তাতো পূরণ হলোনা । "
মা নিশ্চুপ হয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না করছেন, পুত্রকে এই অবস্থায় কোনো মা-ই সহ্য করতে পারবে না, সালাম সেই পবিত্র মায়ের উপর!
মাওলা হুসাইন(আঃ)-এর কন্যা ফাতিমা কুবরা(আঃ) স্বামী কাসিম(আঃ)-এর দেহের টুকরো দেখে খুব ব্যথিত হয়ে বাবা হুসাইন(আঃ) কে বললেন, "হায় আমার কাসিমের দেহও কারবালায় রক্ষা পেলো না, আমি তার লাশকেই ধরতে পারলাম না, কে আমার স্বামী হাসানপুত্র কাসিম কে এভাবে পিষ্ট করলো?"
মাওলা হুসাইন(আঃ) বললেন, "আমার থেকে আমার কাসিম কে যারা ছিনিয়ে নিলো, আল্লাহ যেন তাদের থেকেও সকল রহমত কে ছিনিয়ে নেয়, আমি আমার কাসিম কে যতটা ভালবাসি ততটা জঘন্য শাস্তি আল্লাহ তাদেরকে দিবেন । "
শাহজাদা কাসিম(আঃ)-এর হত্যাকারী ও মাওলা হুসাইন (আঃ)-এর শত্রুদের উপর আল্লাহর লানাত বর্ষিত হোক, আমিন।
মাওলা ইমাম মাহদী(আঃ)-এর প্রতিশোধ নেবার সময় আরও দ্রুত আসুক, আমিন
-01.jpeg)