ইমাম হুসাইনকে কাফের ফতোয়া দিয়ে হত্যা

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

সিফফিন যুদ্ধের মাধ্যমে মুসলিম সমাজ দুটি শ্রেণীতে ভাগ হয়ে যায়। একটি পক্ষ চলে যায় মাওলা আলীর সাথে এবং অপর পক্ষটি চলে যায় মোনাফেক মোয়াবিয়ার পক্ষে। মক্কা বিজয়ের পর যারা জীবন বাঁচাতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে, তারা সবাই মোয়াবিয়ার পক্ষে চলে যায়। এদের সংখ্যাই অধিক ছিল। এই তথাকথিত সাহাবী সমন্ধে পবিত্র কুরআন শরীফে আল্লাহ ঘোষণা করছেন, "মক্কা বিজয়ের পরে যারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে তাদের হৃদয়ে পূর্ণ ঈমান প্রবেশ করেনি। তারা শুধু মুখে ইসলাম গ্রহণ করেছে"। সিফফিন যুদ্ধে মোয়াবিয়া পরাজিত হওয়ার পর গুপ্ত ঘাতক নিয়োগ করে মাওলা আলীকে হত্যা করার জন্য। 

প্রচুর স্বর্ন মুদ্রার বিনিময়ে তথাকথিত মোনাফেক সাহাবী মুলজিম মাওলা আলীকে হত্যা করতে রাজি হয়। এই মুলজিম ছিল একজন হাফেজ। মুলজিম যখন মাওলা আলীকে নামাজরত অবস্থায় হত্যা করার আগ মূহুর্তে সূরা বাকারা আয়াত পাঠ করে এবং মাওলা আলীকে কাফের ফতোয়া দেয়। আর বলে হে আলী তোকে হত্যা করা ফরজ এবং তোকে হত্যা করতে পারলে জান্নাত অবধারিত। আমি একজন কাফের এবং জাহান্নামীকে হত্যা করছি, এই বলে সে তলোয়ার দিয়ে মাওলা আলীর মাথায় কুপ দেয় এবং পরবর্তীতে মাওলা আলী শহীদ হন। 


মোনাফেক মোয়াবিয়া মৃত্যুর সময় সকল প্রাদেশিক গর্ভনর ডেকে কুপুত্র কাফের এজিদকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে যায়। শুধুমাত্র মক্কা ও মদিনার গর্ভনর কাফের এজিদের কাছে বায়াত গ্রহণ করে না। তৎকালীন সমাজের অধিকাংশ সমাজপতি, হাফেজ ও আলেম সম্প্রদায় সানন্দ চিত্তে এজিদের নিকট বায়াত গ্রহণ করে। কিন্ত মাওলা ইমাম হোসাইন এবং সিফফিন যুদ্ধে মাওলা আলীর পক্ষের অনুসারীগণ এজিদের হাতে বায়াত গ্রহণ করে না এবং খলিফা হিসাবে মেনে নেয় না। মোয়াবিয়া মৃত্যুর সময় এজিদকে সতর্ক করে যায়, এজিদ তোমার একমাত্র পথের কাটা ইমাম হোসাইন। তাকে তুমি সরিয়ে দিতে পারলে, তোমার রাস্তা পরিস্কার। এজিদ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে মাওলা ইমাম হোসাইনকে বায়াত হওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু মাওলা ইমাম হোসাইন সরাসরি এজিদের প্রস্তাব প্রত্যাখান করে। এতে এজিদ ক্ষুব্ধ হয়ে প্রত্যেক মসজিদের ইমাম এবং আলেম সমাজকে রাজ দরবারে তলব করে। তখন সকল আলেম সমাজ মিলে মাওলা ইমাম হোসাইনকে কাফের ফতোয়া দেওয়া হয়। কারণ মাওলা ইমাম হোসাইন খলিফা এজিদের নিকট বায়াত গ্রহণ করতে অস্বীকার করছে। আলেম সমাজ রাজ দরবার থেকে উপঢৌকন নিয়ে কুফা, দামেস্ক, বসরা নগরীর প্রতিটি মসজিদের খুৎবায় মাওলা ইমাম হোসাইনকে প্রকাশ্যে কাফের ফতোয়া এবং মাওলা ইমাম হোসাইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ফরজ ঘোষণা করা হয়। আর মাওলা ইমাম হোসাইনের পক্ষে যারা থাকবে, তারাও কাফের হিসাবে গণ্য হবে। পবিত্র কুরআন শরীফের দুটি আয়াত দলিল হিসাবে অপব্যাখ্যা করে। তারা বলে নুহ নবীর ছেলে কেনান এবং রাসূল পাক সঃ এর চাচা আবু জেহেল যেমন কাফের। ঠিক তেমনিভাবে হোসাইন মহামান্য খলিফা এজিদের হাতে বায়াত অস্বীকার করে কাফের হয়ে গেছে। হোসাইন এখন বিদআত এবং কুফরিকাজে লিপ্ত। 


কিন্তু কুফার প্রায় ৪০ হাজার লোক এজিদের ফতোয়া অমান্য করিয়া মাওলা ইমাম হোসাইনের নিকট বায়াত গ্রহণ করার শপথ করে। তাদের দাওয়াতে মাওলা ইমাম হোসাইন কুফা নগরীতে সৈন্য সামন্ত রেখে শুধু পরিবার পরিজন নিয়ে ৮২ জন কাফেলা কুফায় রওনা দেয়। মাওলা ইমাম হোসাইন কারবালা প্রান্তরে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য তাবু ঘারে। এই সুযোগে এজিদের ২২ হাজার সৈন্য ফোরাত নদী এবং চারিদিকে ঘেরাও করে ফেলে। এইদিকে কুফার সেই ৪০ হাজার লোক এজিদের সৈন্যদের ভয় এবং স্বর্ন মুদ্রার বিনিময়ে বেইমানি করে। আর কুফা নগরী অবরুদ্ধ করে রাখে, যাতে মাওলা ইমাম হোসাইনের ভক্তরা হোসাইনকে সাহায্য করতে না পারে। যুদ্ধের ময়দানে মাওলা ইমাম হোসাইন এক জ্বালাময়ী ভাষন প্রদান করে। মাওলা ইমাম হোসাইন বলেন, " আমি তোমাদের সাথে যুদ্ধ করতে আসি নাই বরং তোমাদের দাওয়াতে বায়াত দিতে আসছি। এখন তোমরা যদি বায়াত গ্রহণ করতে না চাও, তাহলে আমাকে মক্কা চলে যেতে দাও। তোমাদের ভিতরে কি একজন মুসলমানও নেই, আমাকে সাহায্য করার জন্য।" অথচ এজিদের সৈন্য বাহিনীর মধ্যে সবাই ছিল তথাকথিত সাহাবী এবং তাবেঈন। এরমধ্যে কোরআনের হাফেজ ছিল ২৫০ জন ও অসংখ্য আলেম ছিল। তাছাড়া এই সৈন্য বাহিনীর অধিকাংশ লোক ছিল সিফফিনের যুদ্ধে মোয়াবিয়ার পক্ষের সৈন্য এবং তাদের সন্তান। মূলত এরা সিফফিন যুদ্ধের পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণ করতেই এসেছিল। 


এজিদের সেনাপতি মাওলা ইমাম হোসাইনকে প্রস্তাব দেয়, হোসাইন তুমি এখন কাফের হয়ে গেছ। তাই তোমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ফরজ হয়ে গেছে। তুমি যদি তওবা করে এজিদের নিকট বায়াত গ্রহণ কর, তাহলে তুমি মুক্তি পাবে। নচেৎ তোমার মাথা কেটে এজিদের নিকট নিয়ে যাব। মাওলা ইমাম হোসাইন বায়াত গ্রহণ অস্বীকার করলে, শুরু হয় অসম যুদ্ধ। মাওলা ইমাম হোসাইনসহ ৭২ জন শহীদ হয় এবং বাকী সদস্য মহিলাদেরকে বেঁধে এজিদের নিকট হস্তান্তর করা হয়। সীমার যখন মাওলা ইমাম হোসাইনের মাথা মোবারক কাটে, তখন সেনাপতি বলে সীমার তাড়াতাড়ি কর আছরের নামাজ কাযা হয়ে যাবে। আমরা সবাই দামেস্ক নগরে গিয়ে আছরের নামাজ আদায় করব। মাওলা ইমাম হোসাইনের মাথা মোবারক বর্শার মাথায় বিদ্ধ করে আল্লাহ আকবর ধ্বনি দিতে দিতে এজিদর নিকট রওনা হয়। মাওলা ইমাম হোসাইনের মাথা মোবারক যখন এজিদের সামনে হাজির করা হয়, তখন এজিদ মাওলা ইমাম হোসাইনের চোখ ও দাত মোবারক খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আনন্দ উল্লাস করে। পরবর্তীতে মাওলা ইমাম হোসাইনের মাথা মোবারক সামনে রেখে দুই রাকাত শোকরানা নামাজ আদায় করে এবং মাওলা ইমাম হোসাইনের মাথা মোবারক বর্শার আগায় বিদ্ধ করে শহরের অলি গলিতে বিজয় মিছিল করে। আর এই বিজয় মিছিলে অধিকাংশ লোক শামিল হয়। আর কিছু হোসাইনি ভক্ত নীরবে চোখের জল ফেলে। 


আমি যখনই ঐসব সাহাবী, তাবেইন, কোরআনের হাফেজ এবং আলেমদের কথা শুনি, তখনই আমি আতকে উঠি। আর হৃদয় ও চোখে মুখে ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। হায়রে সেলুকাস মুসলিম জাতি! যিনি ধর্মের কান্ডারী এবং জান্নাতের যুবকদের সর্দার, তাঁকে হত্যা করে আমরা আনন্দ প্রকাশ করি। এরচেয়ে আজব জাতি সৃষ্টি জগতে আছে কিনা আমার জানা নেই। আজও সেই ধারা সমাজে হুবহু বিদ্যমান রয়ে গেছে।

Next Post Previous Post