নফস কি এবং কেমন ?
আশরাফুল মাখলুকাত সৃষ্টির আদম জাতের শরীরে মধ্যে কয়েকটি মোকাম আছে যা আল্লাহ্ তালার রহমত, বরকত, ফয়েজ ও নূর দ্বারা পরিপূর্ণ। উক্ত মোকাম সমূহের মধ্যে নফস একটি যা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
যে ব্যক্তি তার নফসকে পরিশুদ্ধ করেছে সেই সে রহমত বরকত লাভ করেছেন। আল্লাহপাক কোরআনে এরশাদ করেন- কদ আসলাহা মাংসাক কাহা, ওয়া কদ খবা মাংদাছসাহা (৯১ঃ৯-১০)। অর্থঃঅবশ্যই সফলকাম হয়েছে সে ব্যক্তি, যে নিজেকে (নফস আত্মা) পরিশুদ্ধ করেছে; আর বিফল কাম হয়েছে সেই ব্যক্তি যে নিজেকে পাপাচারে কুলষিত করেছে।
ইসলাম অর্থ সিরাতাল মোস্তাকিম যার অর্থ হচ্ছে জ্যামিতিক সরল পথ যাহার কোন বিকল্প নেই। যদি কেহ জীবন ধারাকে সিরাতাল মুস্তাকিমের পথে চালিত করিয়া আখিরাতে পরিত্রাণ লাভ করিতে চান, তবে মানব চরিত্রের বিভিন্ন দিক গড়িয়া তোলার জন্য মহামানব মোহাম্মদ (সাঃ) এর আদর্শকেই একমাত্র আদর্শরূপে অনুসরণ করুন।
মানব জীবনের এমন কোন দিকের আদর্শ নাই যাহা তিনি রাখিয়া যান নাই। আর তাই একই কারণে নফস বা আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জন করাই মানুষের প্রথম ও মূল কার্য হিসেবে বর্ণনা করা হয়। নফসের পরিশুদ্ধিতার মাধ্যমেই সৃষ্টিকর্তা মহান রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য লাভ করা সম্ভবপর হয়। হযরত আলী (রাঃ) হতে বণির্ত- মান আরাফা নাফাসাহূ, ফাকাদ আরাফা রাব্বাহু (আল হাদিস) অর্থঃযে তার নফসকে চিনল, সে তার রবকে চিনল।
নিজের নফসের পরিশুদ্ধতার মাধ্যমেই মানুষ পরিশুদ্ধতা লাভ করে। নফসের তারনাই মানুষ কু-কর্মে লিপ্ত হয় এবং মহান রাব্বুল আলামিনের রহমত, বরকত থেকে দূরে সরে যায়। তাই নফসের বিরুদ্ধে মনের, জ্ঞানের যে যুদ্ধ বা জেহাদ তাই শ্রেষ্ঠ জেহাদ (জেহাদে আকবর)।
এ সমন্ধে হযরত নূর মোহাম্মদ মাওলা আলী জাল্লাল্লাহ্ বলেছেন- আপন নফসের ফানা যদি নাহি হয়, আল্লাহ্র নৈকট্য পাবে না নিশ্চই । নফসের কার্যক্রম ও বিভিন্ন অবস্থানের কারণে নফসকে তথা মানুষকে বা তার কার্যক্রমকে বিভিন্ন স্তরে ভাগ করা হয়ে থাকে। কুরআনে বর্ণিত আছে- হূম দারাজ্বা তুন ইন্নল্লা-হ; আল্লাহূ বাসিরুম্মিম ইয়া মালূন (৩ঃ১৬৩)। অর্থঃআল্লাহ্ র কাছে মানুষ বিভিন্ন স্তরের। তারা যা করে আল্লাহ্ তার সম্যক দ্রষ্টা। আর তাই নফসের বিভিন্ন অবস্থানের উপর ভিত্তি করে একে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। (১) নফসে আম্মারা (২) নফসে লাওয়ামা (৩) নফসে মুৎমায়েন্না (৪) নফসে মুলহেমা (৫) নফসে রহমানী। ১। নফসে আম্মারা মানস মহাসাগরে স্মৃতিজলে কামরুপে কুমির নিহিত, প্রেমাগ্নির জলন্ত শিখায় দুর্বল চিত্ত আত্মরূপ মানুষের ধর্ম কর্ম সাধনা বিনাশ করে দেয়।
এগুলিকেই এক কথায় নফসে আম্মারা বলা হয়েছে। ইন্না নাফছা লা আম্মারাতুম বিচ্ছুয়ে ইল্লামা রাহেমা রাব্বি (১২ঃ৫৩)। অর্থ ঃ নিশ্চই নফসে আম্মারা বদ কাজ করায়, যাদের আমার প্রভূ রহমত করেন তাদের ছাড়া। নফসে আম্মারাই মানুষের সকল কু-কাজ করায়। এটাকে দমনই তাই প্রথম কাজ। নফসে আম্মারকে আবার ষড়রিপূও বলা হয় এবং এই ষড় রিপুর তারনার কথা প্রায় অনেক ধর্মেও বলা হয়েছে। বাংলা তৎসম প্রতিশব্দে ঐ নফস আম্মারাই (ষড় রিপুর) তমগুন।
তম অর্থ অন্ধকার, অধার্মিকতা, অজ্ঞানতা ও পাপের অন্ধকার। এর থেকে মুক্তি পাবার জন্যই উপনিষদে বলা হয়েছে- তমোস জোতির্গময় অর্থ ঃ অন্ধকার হতে হে প্রভু আমাদের আলোকে নিয়ে চলো। এই সমন্ধে কুরআনে বলা হয়েছে- রাব্বানা আতমেমলানা নূরানা (৬৬ঃ৮) অর্থঃ হে আমাদের প্রভূ আমাদের আলো পূর্ণ করো।
নফসে আম্মারার কুরিপুর মধ্যে ষড়রিপু ছাড়াও আরও ১২টি কু-রিপু বিদ্যমান যাকে মোহলিকাত বলা হয়। এই মোহলিকাত কে ধ্বংস করে তার স্থলে মোনজিয়াত প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। মোনজিয়াত সমন্ধে বলা হয়েছে ঃ তুমি যদি মওলা পাকের নিকটবর্তী ও আশেকানে মাওলার প্রিয় পাত্র হইতে চাও তবে আপন হৃদয়কে দশটি বিষয় শিক্ষা দাও।
মোহলিকাতকে ধ্বংস করে মোনজিয়াত প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নফসের উন্নতির ক্রম বিকাসে মানুষ নফসের পরবর্তী স্তরে বা নফসে লাওয়ামাতে পৌছান। ২। নফসে লাওয়ামা ঃ লাউকছেমু বে ইয়াওমুল কিয়ামা অলা উফছেমু বেন্নাফছে লাওয়ামা (৭৫ঃ১/২) অর্থ ঃ আমি কসম করছি কিয়ামতের দিন আরও কসম করছি (সেই আত্মার যে নিজেকে তিরস্কার করে থাকে) নফসে লাওয়ামার। তিরস্কারকারী আত্মাই হল নফসে লাওয়ামা এবং কেয়ামতের সংশ্রবে নফসে লাওয়ামা বলার তাৎপর্য হলো মৃত্যুর পর যে আত্মার হিসাব নিকাশের জন্য পুনরুত্থ্যান। তাই কিয়ামত।
নফসের প্রথম উত্থ্যান হল নফসে লাওয়ামতে পৌছানো যা কিনা নফসে আম্মারার পতন। এই অবস্থায় নফসে আম্মারার তাবে হঠাৎ পাপ কার্য করে ফেললেও অনুতাপের অন্ত থাকে না। এই জন্যই তখনকার আত্মার কয়ফিয়ত (হাল) নফসে লাওয়ামা অর্থাৎ ভৎসনাকারী, তিরস্কারকারী। আত্মা পাপের পরক্ষনেই ঐ আত্মা করে জবর ভৎসনা কেন পাপ করল, তার ফলশ্রুতি হয় অনুতাপ। সুতরাং, এই আত্মা এর এ ধরনের অনুতাপের নামই তত্তবাতুন্নাছুহা, শুদ্ধ সরল অন্তঃকরণের তওবা বা অনুতাপ। আর এই অনুতাপ বা তওবা হচ্ছে ষড় রিপুর সঙ্গেঁ অভ্যন্তরীন লড়াইও বটে। এজন্য রাসূল (সাঃ) বলেছেন- আশাদ্দোল জেহাদে জোহাদ্দোল হাওয়া অর্থাৎ ঃ রিপুসমূহের সংঙ্গে যুদ্ধ জেহাদে আকবর বা শ্রেষ্ঠ জেহাদ। নফসের এই স্তরকে অতিক্রম করতে পারলেই পরবর্তী স্তরে পৌঁছা যায়।
বা আমরা বলতে পারি নফসের উন্নতিই হচ্ছে নফসে মুৎমায়েন্না। ৩। নফস মুৎমায়েন্না ঃ ইয়া আইয়াতুহান্নাফছুল মুৎমায়েন্না তুরজিই ইলা রাব্বেক রাজিয়াতাম মারজিয়া ফাদখুলি এবাদি অ আদখুলি জান্নাত (৮৯ঃ২৭-৩০) । অর্থ ঃ হে প্রশান্ত আত্মা ! তুমি তোমার রবের কাছে ফিরে এসো এমনভাবে যে, তুমি তার প্রতি সন্তুষ্ট এবং তিনি তোমার প্রতি সন্তুষ্ট; অত:পর তুমি শামিল হয়ে যাও আমার বিশিষ্ট বান্দাদের (পয়গাম্ভর অলী, আবদাল, গাউছ-কুতুব, মুজাদ্দেদ-মুজাহীদ ) মধ্যে, এবং প্রবেশ কর আমার জান্নাতে।
কাজেই আল্লাহ্র সঙ্গে বান্দার তথা পরম আত্মার সঙ্গে আত্মার একটা নীবিড় যোগাযোগ হয় পাপ তাপের সঙ্গে লড়াইতে। রিপুগুলোকে পরাস্ত করতে পারলে তা হয় মানুষের আওতাধীন। এই অবস্থায় সৎ ও মহৎ, প্রেম-প্রেরণা ও তদনুগ কার্যের সহায়ক হয় অর্থাৎ আল্লাহ্র হূকুম আহাকাম এবং তার সাথে সম্পর্ক স্থাপনে। এই অবস্থা দায়েম কায়েম করতে পারলেই পরবর্তী স্তরে পৌঁছা যায়।
৪। নফস মুলহেমা আন্নাফছে অমা দাওয়াহা ফা আল হামাহা ফাজুরাহা অ আক্বওয়াহা (৯১ঃ৭.৮)। অর্থ ঃ কসম মানুষের আত্মার এবং যিনি তাকে আকৃতিতে সুঠাম করেছেন, অতঃপর তাকে তার মন্দকর্ম ও তার তাক্ওয়ার জ্ঞানদান করেছেন। অর্থাৎ বলা যায় যে, কোনটা পাপ সুতরাং তা পরিত্যাগ করতে হবে কোনটা পূর্ণ যা গ্রহণ করতে হবে। তা তিনি তার প্রিয়তম রহমানুর রাহিমের তরফ থেকে এলহাম অনুপ্রেরণা যোগে জেনে শুনেই করেন। যা সাধারনের গন্ডির পাপ পূর্ণের বিচারের উর্ধ্বে। খিজির (আঃ) হযরত মূসা নবীকে- আমি নিজের ইচ্ছায় কিছুই করিনি; এই ইচ্ছে যাতে তুমি ছবর করতে পারনি তারতাবীল। উপরের ঘটনার দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা পরিস্কার দেখতে পাই যে, যারা আল্লাহ্র সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে তারা তার এলহামের অনুপ্রেরণা যোগে জেনে শুনেই করেন।
যা সাধারনদের আপাতদৃষ্টিতে বোধগম্য না হলেও তা কল্যাণময়। ৫। নফসে রহমানী নফসে মূলহেমা পাকা কায়েম দায়েম হলেই সম্ভবপর হয় নফস রহমানী। একেবারে রহমানুর রাহিমের খাছলত হাসেল হলেই বলা যাবে নফসে রহমানী। তাখাল্লাকু বে আখলাকিল্লাহ্ (হাদীস একারনেহ্)। অর্থ ঃ আল্লাহ্র গুনে গুণান্নীত, আল্লাহ্র জ্ঞানে জ্ঞানান্নীত, আল্লাহ্ র শানে শানান্নীত হও। কোরনে আল্লাহ্পাক বলেন- ছিবগ্বাতাল্লাহ আমান আহছানু মিনালাহি ছিবগ্বাতাউ অনাহুনু লাহূ আ-বিদুন (২ঃ১৩৮)। অর্থ ঃ আমরা গ্রহণ করলাম আল্লাহ্র রং।
আল্লাহর রং এর চেয়ে উত্তম রং আর কার হতেএখানে একেবারে রহমানুর রাহিমের খাসালত হাসেল করতে হবে। আল্লাহ্র গুণে গুণান্নিত এবং তাঁর জ্ঞানে জ্ঞানান্নিত হতে পারলেই নফসে রহমানী হাসিল হবে এবং কি আছে উত্তম আল্লাহ্ চাইতে, সুতরাং যে আল্লাহর গুণে গুনান্নিত সেই তো সর্বাপেক্ষা উত্তম মানুষ। আমরা জানি/জ্ঞাত আছি আল্লাহ মানুষকে আশরাফুল মাকলুকাত ঘোষণা করেছেন।
লাকদ খলাকনাল ইনসানা ফি আহসানি তাকুইন (৯৫ঃ৪)। অর্থ ঃ আমি তো মানুষকে সৃষ্টি করেছি অতিশয় সুন্দর গঠনে। তবে যদি কেউ এই রহমানুর রাহিমের খাসালত ধারন করতে পারে সেই পূর্ণময় সর্বোত্তম।